সূরা ফাতিহা মূলত একটি প্রার্থনা এবং একই সাথে এটি একটি অঙ্গীকারনামা। আবার এটি পবিত্র কোরআন মজিদের ভূমিকা বা মুখবন্ধও বটে। এই প্রার্থনা, অঙ্গীকারনামা বা ভূমিকাটির তেলাওয়াতের মধ্য দিয়েই কোরআন পাঠ শুরু করতে হয়। এই সূরাটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, নামাজে এটি পড়া বাধ্যতামূলক বা ওয়াজিব করা হয়েছে এবং প্রতি রাকায়াত নামাজে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হয় না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পাঠ করেনি তার নামাজ হয়নি। এ কারণে প্রতিদিন, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের প্রতিটি রাকায়াতে আমরা সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে থাকি।
কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিদিনের নামাজে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে আমাদের পরওয়ার -দিগারের নিকট কী প্রার্থনা ও অঙ্গীকার করে থাকি তাকি আমরা জানি? সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিমই নামাজে পঠিত সূরা সমূহের, বিশেষ করে সূরা আল ফাতিহার অর্থ. তাৎপর্য ও এর শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন নই। আর সচেতন নই বলেই তো আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীপ্রীতি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে; ব্যক্তিপূজা, ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্য-অনুসরণ তথা দেবতাতন্ত্র আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে, আমাদের রাজনীতি এমনকি আমাদের ধর্মকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছে; সচেতন নই বলেই তো আমরা স্রষ্টার নৈকট্য ও হেদায়াত সন্ধানের জন্য, সিরাতুল মুশতাক্বিমের পথের দিশা জানার জন্য আল্লাহ্র কালাম আল কোরআনের পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষ বা তথাকথিত পীর, দরবেশ, বুযুর্গ, ও মুরুব্বিদের কাছে ধর্ণা দেই, তাদের কথাকেই দ্বীন মনে করি, কোরআনের সাথে তাদের কারো কোন বক্তব্যকেই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি না বরং ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্য করতে যেয়ে তাদের বয়ানকে প্রকারান্তরে কোরআনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আর এ সবই আল্লাহ্রর কালাম আল কোরআনের শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল।
আসলে একটি সমাজে পৌত্তলিকতার উত্থান একদিনে হয় না। যে কাবাঘর ছিল তাওহীদের কেন্দ্রভূমি সেই কাবাঘরেই এক সময় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এবং তা একদিনে হয়নি। মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজা নিঃসন্দেহে শিরকের চূড়ান্ত রূপ; কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের উপর দেবত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে। মূলত, কোন মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষকে যখন অতিমানব মনে করা হয়, তখনই তার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। এর প্রকাশ দেখা যায় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে ইহুদি ও খৃষ্টানরা তাদের পূর্বপুরুষ ও আল্লাহর রাসূল মনে করে। মক্কার কুরাইশরাও কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এরই বংশধর এবং পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা সেবায়েত। আর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সারা জীবন তাওহীদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাইল (আঃ) পবিত্র কাবাঘরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাওহীদের কেন্দ্র রূপেই। অথচ তাঁদেরই বংশধর মক্কার অধিবাসীরা পবিত্র কাবাঘরকে মূর্তিপূজার আখড়ায় পরিণত করেছিল। অন্যদিকে ইহুদিরা হযরত ওজাইরকে আর খৃষ্টানরা হযরত ঈশা (আঃ)-কে আল্লাহ্র পুত্রে পরিণত করেছিল। এটি একদিনে হয়নি। আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকে বড় করে তোলা তথা ব্যক্তিপূজার পথ ধরেই শত শত বছরের বিকৃতির এক পর্যায়ে পৌত্তলিকতার প্রকাশ্যরূপ মূর্তিপূজা আত্মপ্রকাশ করে।